ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

‘কত রবি জ্বলে, কে-বা আঁখি মেলে’

পাহাড়ের বোবা কান্না শোনার কি কেউ নেই!

:: এম.আর মাহমুদ ::

আমি পাহাড়, নড়াচড়া করতে পারি না, কথাও বলতে পারি না, তবে আমি পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রেখে আসছি পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে। আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছে পৃথিবীর পেরেক হিসেবে। আমি কখনো ন্যাড়া ছিলাম না। আমার চূড়ায় ছিল হরেক প্রজাতির বৃক্ষরাজি। তখন আমাকে দেখতে নান্দনিক মনে হত। সেখানে নিরাপদে বসবাস করত হরেক প্রজাতির বন্যপ্রাণী।

বর্ষা মৌসুমে প্রবল বর্ষণের সময় বৃষ্টির পানি সরাসরি আমার উপর পড়ত না। বৃষ্টির পানি পড়ত বৃক্ষরাজির পাতা-পল্লবে। যে কারণে আমার মাটি ক্ষয় হয়ে পানির সাথে একাকার হয়ে নদী, খাল ও ছড়ায় গড়িয়ে পড়ত না। বর্তমানে আমার উপর প্রাকৃতিক ভাবে গজিয়ে উঠা গাছপালা সাবাড় করে ন্যাড়া মাথায় পরিণত করেছে লোভী মানবকূল। ফলে আমি এখন ছাতাহীন বৃষ্টির পানি সরাসরি আমার মাথার তালুতে আঘাত করছে। ফলে আমার সু-উচ্চ পাহাড়ের মাটি ক্ষয় হয়ে খাল, নদী ও ছরায় এসে নাব্যতা সৃষ্টি করছে। ইদানিং আমি মানব সমাজের অত্যাচার সহ্য করতে পারছি না। ফলে অনেক সময় আমি ধসে যাচ্ছি। এতে পাহাড়ে বসবাসরত মানুষগুলো অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমার উপর চলছে স্কেভেটরের কোপ। যে কারণে আমি বিপণ্ন হয়ে সাবাড় হয়ে যাচ্ছি। মানব কল্যাণে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড চলছে। এসব উন্নয়ন কর্মকান্ডে নির্বিচারে আমাকে হত্যা করে আমার মাটি নিয়ে যাচ্ছে ওইসব প্রকল্পে। এসব কাজে লিপ্ত রয়েছে বড় বড় ঠিকাদার ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। এছাড়া আমার পাদদেশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইটভাটা। ইটভাটাতেও যাচ্ছে আমার মাটি। যেহেতু আমি কথা বলতে পারি না, সে কারণে প্রতিবাদ করার ভাষা আমার নেই। প্রতিনিয়ত বোবা কান্না ছাড়া আমার কোন গতি নেই। আমাকে রক্ষার জন্য সরকার বনবিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে দায়িত্ব দিয়েছে। তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে তা আমি বলতে যাব কেন? বেশুমার পাবলিক, দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা এসব দেখলেও রহস্যজনক কারণে মরুভূমিতে ঝড়ের সময় ‘উট পাখি’ যেভাবে বালিতে মাথা গুজিয়ে রাখে সেভাবেই অবস্থান করছে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ ও কক্সবাজার উত্তর-দক্ষিণ বনবিভাগের পাহাড়গুলো ছিল এক সময় বড়ই নান্দনিক। এখন কিন্তু সে অবস্থা নেই। লাগামহীন ভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে পাহাড় ও বনভূমি। দায়িত্বশীলরা দেখেও দেখছে না এ যেন গনিমতের মাল। নির্বিচারে পাহাড়ও বন নিধনের কারণে বন্যপ্রাণী আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বনাঞ্চলে তেমন কোন প্রাণীর সন্ধান মিলছে না। হাতে-গোনা কিছু হাতির পাল থাকলেও খাদ্য সংকটে পড়ে প্রতিনিয়ত লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হত্যা করছে। এসব যেন প্রকৃতির প্রতিশোধ। হয়তো ক’দিন পর দোহাজারী থেকে ঘুনধুম হয়ে কক্সবাজারে রেল যোগাযোগ শুরু হবে। এ কারণে রেলের রাস্তা নির্মাণ করতে গিয়ে বর্তমানে বেশিরভাগ পাহাড় নিধন যজ্ঞ চলছে। কবির ভাষায় বলতে হয় ‘আসিতেছে শুভ দিন, দিনে দিনে বাড়িতেছে বহু দেনা’ শুধিতে হইবে ঋণ।’ এভাবে পাহাড় নিধন অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বিপর্যয় বেশিদিন দূরে নয়। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর ভাষায় বলতে হয় ‘গাছেরও প্রাণ আছে’ এছাড়া পাহাড়ে যে প্রাণ নাই তা কি বলা যায়? শুধু পাহাড় ও বৃক্ষ নয় সাথে পাহাড়ের ভিতরে থাকা পাথরও লুটে নিচ্ছে মানবকূল। সরকার প্রতি বছরই বনায়ন করে বন সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। হয়তো কিছু কিছু বন নতুন ভাবে সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি ধ্বংস প্রাপ্ত পাহাড়গুলো কি কোন দিন সৃষ্টি করা যাবে? পাহাড় ছাড়া বনের কোন গুরুত্ব নেই। কিছু কিছু জায়গায় এসব পাহাড় এখনও আছে বলে ভ্রমণপ্রিয় লোকজন এখনও ওইসব পাহাড়ে গিয়ে আনন্দময় দিন কাটাচ্ছে। তবে আগামী প্রজন্ম যাবে কোথায়?

লেখক: মাহমুদুর রহমান মাহমুদ, সভাপতি -চকরিয়া প্রেসক্লাব, চকরিয়া, কক্সবাজার।

পাঠকের মতামত: